আট টি অ ণু গ ল্প
শব্দ যাত্রা
আমি বলালাম, কপালের নাম গোপাল। বহুল প্রচলিত এ কথার অর্থ বুঝে অথবা না বুঝেই শাহিনা শুধু ঘাড় নাড়লো। কেনোনা তাকে তো পেয়ে বসেছে জৈন্তাপুরের লালখান জাফলঙের সাদা নুড়ি কুয়াশায় ঢাকা দূরের ঝাপসা বন তামাবিলের জিরোপয়েন্ট। ঘোর লাগা এক অসম্ভব আকর্ষণ তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে অনেকক্ষণ। যেন চারপাশ জনমানব শূন্য। মোহতার ঘনিষ্ঠতা যেন তার সমস্ত মন্ত্রনা ঢেলে নিরেট পাথর করে রেখেছে তাকে। খেয়ালের খোলতা তালে নিজেকে যে একটু নাড়াবে বোধকরি সে সুযোগটুকু তার নাই। হাওয়াই দুলছে তার ছড়ানো চুলের রাশি। গাড়ির উইÐো গøাস গলিয়ে আবছায়ার খেলা তাকে নিয়ে মেতেছে বেশ। নিরুপায় বিবশ, দীর্ঘযাত্রার আবেদন আর পরস্পরের অব্যক্ত বুলির অস্ফূট ব্যথা তখন বোতল বন্দি ভ্রমরের মত ছটপট করে। তবু তুলনাহীন, অনবদ্য। থেকে থেকেই একাট মায়া টান ছিটকে দিচ্ছে ছায়ার ছন্ন বাসনাকে আমাদের বুক থেকে। বৃষ্টির মত রোদকে ঝরতে দেখে একটু বিস্ময় লাগে বৈকি তবু নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে তাকাতেই একফালি ঠোঁট চোখ বরাবর এসে দাঁড়ায়। অবাক ! ভাইজান একটা ছকলেট নিতানি,লাফ ক্যান্ডি। বলেই একমুঠো চকলেট কোলের ওপর রেখে মেয়েটা চলে গেল। মেয়েটার বয়স বারো কি তেরো হবে। লম্বাটে গড়ন। বেশভূষা আর চেহারাতেও বেশ পরিষ্কার। কিন্তু তার সাবলিল দৈন্যতার মাঝেও যে আত্ম দৃঢ়তা ভাঙনের ধার থেকে উঠে আসা ঘাসের মত তা তার চলনই বলে দেয়। অন্য সব যাত্রির ক্ষেত্রে এমনটা হলো না। ততক্ষণে শাহিনার ঘুম চেতনার আলোতে চোখ মেলেছে। আমরা কোথায়, কতো দূর ? ঢাকা ছেড়েছি। ওমা এসব আমার কোলে কোত্থেকে এলো। বলতে বলতেই ও পিলো প্যাকের চকলেটটার মাঝ বরাবর ধরে দু’হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলকে এক করে আলতো একটা টান দিলো। মনে হলো আঙুলে আঙুলে আনন্দের খেলা। তারপর টুপ করে মুখে পুরে নিয়েই বললো, তুমি একটা খাবে নাকি। কিছু না বলে গাড়ির ফোল্ডিং সিটের স্টেয়ারকে একটু সামনের দিকে টেনে এবার সোজা হয়ে বসি। যাত্রাবিরোতি তো শেষ হয়ে এলো কিন্তু মেয়েটা গেল কোথায়। গাড়ি যে ছাড়ার সময় হয়ে গেল। ও টাকা নিবেনা নাকি ! সুপারভাইজার গাড়ির মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বললো,সম্মানিত যাত্রিবৃন্দ নিজ নিজ আসনে বসে পড়–ন এখ্খুনি গাড়ি যাত্রা শুরু করবে।- কোনো তুমি ওকে টাকা দাওনি ? -না। তাহলে ফ্রি ফ্রি খেয়ে নিলাম ! এমন সময় মেয়েটি এলো আর চকলেটের এমন সার্ভিস দেয়ার জন্য তিনগুণ টাকা বেশি নিয়ে চলে গেল। এতে আমার মুখটা হা হয়ে থাকাতে ও বললো, মুখটা বন্ধ করো খারাপ দেখাচ্ছে। চলতে চলতে এক সময় যথারীতি যাত্রা ভঙ্গ হলো। নামলাম সিলেটের জৈন্তাপুরে। ওয়াই আকৃতির রাস্তাটার মাঝখানে একটা মন্দির দেখে মনে বেশ কৌতূহল জাগলো। দুজনেই সামনে গেলাম। পূজারিকে জিঙ্গেস করলাম, এখানে এটা কোন দেবতার মন্দির। তিনি কিছুটা
বিস্ময় নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,কিতা মাত্ মাতো ?
লাইফ সাপোর্ট
যাপিত জীবনের পাতায় পাতায় লেগে থাকে সাবধানে চলার অনুশাসন। তারপরও অসাবধানতার ঢেউয়ে টালমাটাল হয়ে যায় জীবন তরী। কিন্তু এমনও ঢেউ আছে যার তোড়ে ভেসে যাবার প্রার্থনা নিঃসঙ্কোচে বাসা বাধে মনের অন্দরে। রোদ তখন খানিকটা দাঁতাল। আর খানিকটা মাতাল, মেঘ মিতালীর দেখা না পেয়ে। দিন পনেরো হলো হাসপাতাল ছাড়া। কার্ডিওলজিস্ট বলে দিয়েছেন সাবধানে চলা ফেরা করতে। তাই রোদের তীব্রতা বেশি হলেই খুজতে হয় একটু নিরাপদ আশ্রয়। বিধায় ল²ীপুরের এই চায়ের দোকানে বসা। মনু ভাই, দুধ চা না রঙ চা ? ফ্ল্যাটের প্রতিবেশি এ কথা বলতেই সাগ্রহে পাশে বসালাম। নাহ্ , রং চা’ই খাই। তিনি কোন আপত্তি করলেন না। শুধু বললেন খাওয়াতে কি আসে যায়, সম্পর্কটাই আসল কথা। আরে ভাই সেটিই তো থাকছে না। হাত ফসকে পড়ে যাওয়া চিনেমাটির থালার মত ভেঙে যাচ্ছে। এখন আবার কি হলো ? কিচ্ছু নাহ্, এমন হতাশার বাতাস বুক থেকে রেেেরাতেই লোকটার মুখ থেকে খুলে পড়লো সত্তর বছরের অপ্রাপ্তি। যৌবনে ছেড়ে গেল মালতি,বয়সকালে ছেলে-মেয়ে আর শেষ বিকেলের ¤øান রোদে প্রাণের স্ত্রী। এসব ছাড়াই আপনিতো ভাই আপনার হার্ট নিয়ে ভালোই আছেন। দু’জনেই হো হো করে হাসতে হাসতে একজন হঠাৎই থেমে যায়। আর লোকে বলাবলি করে মনু মিয়ার আপন কেউ ছিলো না, ওই লাইফ সাপোর্ট ছাড়া।
কাঁটা
ধুর শালা, খ্যাড়ের ব্যাড়ে পা চলতিই চাহাছে না। ওই মুকা, আর কদ্দুররে ? দ্যাখ্ য্যাতে য্যাতে যদি কুন্ঠে ঠ্যাক লিয়্যা হদিস হারা হয়্যা য্যাস্ তাহিলে কিন্তু খবর আছে। শালার জাইত নাশা মিয়্যামানুষ, যদি আইজ ধরতে পারি তাহিলে অখে ভাত ছুটাবোই ছুটাবো। দ্যাখো হবি ভাই, অতো মাথা গরম ক্যইরো নাখো। মুকাম্মেল ওরফে মুকা মিয়ার এমন কথা শুনে হবি মেম্বার কিছুটা শান্ত হয়। আর জোরে জোরে পা চালায়।
বিড়ালের মত খুব সন্তর্পনে পা ফেলে শিকারের দিকে তারা এগিয়ে যায়। মনে হয় যেন চোর ধরবে। একটু করে যুগি পাড়ার শেষ বাড়িটার পিছেেন যেয়ে তারা থেমে যায়। আশ্রয় নেয় একটা কলার মাদে। কিন্তু না কমেলার কোনো দ্যাখা পায় না। ও বাড়ির কাইমুদ্দি একাই ঘর থেকে বের হয়ে আসে। মুকার মাথায় একটা চাটি মেরে, শালার মুকা-সব সময় ভুল খবর দিস্! চল্। বাড়িতে এসে দ্যাখে কমেলা খুব স্বাভাবিক, ও তুমি আইস্যাছো, গোসুলধড়ি কর্যা খা য়্যা ল্যাও। ক্যানে তুই খাবি ন্যা ? আমি কালাইয়ের বড়ি দিবার লাগ্যা নামু পাড়ায় ভাত্যা কুমড়্যাহ আইনতে যাবো। স্বামীকে এ বলে কমেলা নামু পাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কিছুক্ষণ থেমে থেকে হবি মেম্বারও কমেলার পিছু নেয়। আর গিয়ে থামে সন্দেহ করা ওই বাড়িটার ঠিক পিছনে। এবার কলার মাদে নয় বরং একেবারে কাশছনে ছাউয়া বেড়ার কোল ঘেষে।-ইস্, শালার মশা, সবগুলান য্যান পোয়াতি ধানের শীষ। ক্যামুন ঠ্যাপা ঠ্যাপা। এ গা-গতর আর কঞ্চির টাটিতে লাগ্যা আছে ক্যামুন। যাউগ্গা, কপাল অ্যাতো ঘাইমছে ক্যানে, ও বাবা দেখছি গুল্ল্যা বাহ্যা রক্তও বারাহ্ছে, অ্যাঁ পায়ে যে কাঁটালোট্যা ঢুক্যাছে !
বিশ্বাস
বাবার বয়স শত বছর ছাড়িয়ে গেছে। তাই বড় ভাইদের কাছে মানুষ অর্পিতা। কিন্তু গভীর রাতে তার ঘরে নেকসাদ কে পেয়ে জীবনে প্রথমবারের মত ভাইয়েদের কাছে সে অবিশ্বাসী হয়। পরে অবশ্য ভালোবাসার মানুষটির সাথেই ঘর ছাড়ে অর্পিতা। নেকসাদ টলি চালায়। পৈতৃক দু’কাঠা জমির ওপর কঞ্চির বেড়ার ওপর কাদা দিয়ে ঘর তুলেছে। হঠাৎ একদিন ডাক পিয়ন এসে হাজির। নেকসাদ এখানে একাট সহি করো। আর এ টাকা গুলো ধরো।- কিন্তু এতো টাকা ! কে পাঠালো ? তা তুমিই জানো। লন্ডনের ব্রিকলেন থেকে মিস্টার আজাহার নামের কেউ এ টাকা পাঠিয়েছে। গুণে নাও দশ হাজার আছে। নেকসাদ এবার স্মৃতির পর্দায় শক্ত করে একটা ধাক্কা দিলো। আর অমনি ফুটে উঠলো আজাহার চাচার ছবি। মা’র কাছে শুনেছিলো কোন এক দুরসম্পর্কের চাচা নাকি লন্ডনে থাকে তিনি নিঃসন্তান। এ প্রাপ্তিতে অর্পিতার মনেও আনন্দের সঞ্চার হলো। ভাবলো আগামাী দিনগুলো হয়তো ভালোই কাটবে। এর মধ্যে বিবাহিত জীবনের সাতটি বছর কেটে গেছে। দুটি ছেলেও রয়েছে। কিন্তু আর কোনো মানি অর্ডার আসেনি। একদিন সেই চাচা সশরীরে নিজেই এসে হাজির। তবে ফরাদপুরের গ্রামে না এসেছেন রাজশাহী শহরের লক্ষীপুরে। উঠেছেন কোন এক হোটেলে। আর সেখানেই ডেকেছেন সব আত্মীয়-স্বজনদের। ডাক পেয়েছে নেকসাদও। ছেলেদের রেখে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে নেকসাদ সেই হোটেলে চাচার সাথে দেখা করলো। অন্যসব আত্মীয়ের মত চাচা তাকেও পাঁচ লক্ষ টাকা দিলো। আর বললো তোমরাই তো আমার সব। আমার তো কোনো সন্তান নাই। তবে অর্পিতা তার পেটে আলসার এ কথা বলতেই চাচা তাকেও দুই লক্ষ টাকা দিলো। সব মিলিয়ে সাত লক্ষ টাকা গ্রামীণ ব্যাংকে ফিকস্ড ডিপোজিটে রেখে দেয়। নেকসাদ-অর্পিতার সংসার ভালোই চলছিলো। হঠাৎ একদিন লন্ডন থেকে চাচী নেকসাদকে ফোন করলেন, তোমার চাচা মারা গেছে। মৃত্যুর আগে তার সমস্ত গচ্ছিত টাকা তোমাদের সব আত্মীয়-স্বজনদের নামে ভাগ করে দিয়ে গেছেন আর বলে গেছেন তার জন্য যেন দোয়া খায়ের মিলাদ-মাহফিল করা হয়। তাই তোমরা তা করে তার একটা ভিডিও কপি সিডি করে লন্ডনে পাঠাবে। দেখবো কেমন হয়েছে আয়োজন। নেকসাদ গোটা গ্রাম মাইকিং করে সে মতই দোয়া মাহফিলের আয়োজন করলো, জমায়েতও ভালো হলো, তবারকও বিতরণ করা হলো। এতো সব আয়োজনের ভিডিও কপি পেনড্রাইভে করে নিয়ে গেল সিডি করতে শহরে। কিন্তু বিধিবাম পেনড্রাইভ কম্পিউটারে ওপেন করে দেখা গেল ভাইরাস অ্যাটাকে সব মুছে গেছে।
ফিদার তুলি
বুড়ো শিয়াল ফাঁদে পড়লে ভয়ের চেয়ে লজ্জা পায় বেশি বুঝলে বিষু কাকা। কিন্তু তোমার তো দেখছি লজ্জা বলে কিছুই নেই। দুই কাল গিয়ে শেষকালে পড়েছো। তবু ভিমরুতি যায়না না ? গাছে দড়ি দিয়ে বাধা অবস্থায় বিষু কাকা মাথা নিচু করে বললো,ভাইপো আমারে ক্ষমা করি দাও। আমার মুখে কোনো কথা সরে না। নিরবে সেখানকার ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসি। সামনে মনে হয় সমস্ত পথই অন্ধকার। কোথাও একটুও আলোর দেখা নাই। অথচ তখন সূর্য মাথার উপরে। বিষু কাকা এ বয়সে এ রকম করতে পারলো ? নাতি-নাতনিদের কথাও একবার ভাবলো না! নাতবো কে ঝড়িয়ে ধরা। ছিঃ! এমন ধিক্কারে ভরে গেল গোটা পাড়া। অথচ বেড়ে গেল আমার বুকের শূন্যতা। ঘরে গিয়ে ইজেলের ক্লিপে আটকিয়ে দিই নতুন একটা কার্টিজ। কিন্তু চিন্তায় কোনো রূপ আসে না শুধু কাকার ছবি ভাসে। নাতবোর কি গাল রাঙা ছিলো। অভিসারের পথ কি বয়সকে অজ্ঞান করেছিলো। হয়তো। তমালিকা এখনো আসছে না কোনো। তার মুখ যে তুলির ডগায় চুমু খাবে চিন্তার উত্তঙ্গু এসময়ের আকরে তাও বলে না। তবে দরজার পাশে কি যেন শব্দ হলো, খুলে দেখি এ কি পুরো তমালিকা ! গায়ের ক্যানভাসে তার মসলিন আবরণ। ফিদার তুলিতে চোখ, জল্জল্,উজ্জ্বল। লজ্জা রমণীর ভূষণ নয়, অস্তিত্ব। ভূষণ হলে টানাটানিতে খসে পড়ে যেতো। অস্তিত্ব বলেই সত্তার সাঙ্গে আটকে থাকে। তাহলে কি এতে মূক প্রমথনাথ বিশী । তখন রঙে ভিজে যায় তমালিকার সমস্ত দেহ।আর বুড়ো শিয়ালেরা চোখ খুলে রাখে রাতের কাছে।
ক্লিব পাঁচালি
তোদের আগেই বলি, চল এখনই কেনাকাটা সেরে ফেলি। না, এখনো ঈদের পনেরো দিন বাকি। দু’দিন আগে কিনবো। বলি, এমন হলে কি চলে ! আরে বাপের অবস্থাটা বুঝতে হরে না ! সময় পেলে তবে তো কেনাকাটা হবে। কে শোনে কার কথা। সবাই চললো যে যার মতো। তাহলে আমার আর কি করা, আমিও চললাম আমার মতো অফিসে। নিস্ নিস্ হুড়োহুড়িতেই সেরে নিস্। আমি আর তোদের কিছু বলবো না। । চশমাটা ভুলে গেছি, বুঝলে নিসু’র মা। যাওয়ার সময়তো একটুও খেয়াল করিয়ে দিবে না। তাই তো যেতেযেতে মাঝ পথ থেকে আবার ফিরে আসতে হলো। চশমাটা নিয়ে তড়িঘড়ি বের হয়ে গেলো নকিব সাহেব। ঈদের এখনো বিশ দিন বাকি, পকেট এখনই গড়েরমাঠ। কবে বোনাস পাবো, এদিকে একগদা কাজ জমে আছে। ঠিকাদাররা বিল তোলার জন্য মরিয়া। তাদেরওতো ঈদ বলে কথা! তাহলে, ঈদ নেই কাদের ? একথা ভাবতে ভাবতে চা ঠান্ডা হয়ে গেলো।- কি নকিব সাহেব লাল শরবত কবে থেকে পান করা ধরলেন। বলে সব স্টাফ একটু হাসাহাসি করলো। কিন্তু ভাবনা কাটলো না। ভাবতে ভাবতে অফিস রুমের বাইরে এলেন। ও¤িœগায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো,-কিরে দিবি না, দে না একটু ! ইস্ চল ঈদ করতে আড়ে যাই। তাড়াতাড়ি এক’শ টাকা দিয়ে নকিব সাহেব এ যাত্রা রক্ষা পায়। তাদের অঙ্গভঙ্গি, কমাতুর আবেদন আর নাছোড়বান্দা নোংরা ভাব যে কেউ ঘায়েল হতে বাধ্য। তবে নকিব সাহেব আগে থেকে জানতেন বলে কথা না বাড়িয়ে টাকাটা ধরিয়েছেন। ঈদ এলো কিন্তু ভাবনা গেল না। ঈদ নেই কাদের ? দুই ছেলে, ছেলের মা সঙ্গে আছে আরডিএ মার্কেটের একত্রিশ নম্বর দোকান। শত লোকের ভিড়ে বুকের কাপড় খুলে জবর-দখলি বায়না - দে পাঁচ’শ রুপিয়া দে, নেহি তো নাঙ্গা করদেঙ্গে। এমন কথা শুনে নকিব সাহেব চমকে উঠলো। দোকানিরাও বলাবলি করতে লাগলো, য়েঁ মগের মুল্লুক পায়াছে । এ কথা শুনে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেলো। -হামলোগ অ্যাইসেই পেট ভরতে হে। রুপিয়া দিলি না শালা, তেরা ওপর হায় পড়েঙ্গে, খুদাকি গজব পড়েঙ্গে। এই বলে উদ্যত বুকের আক্রোসে আলিঙ্গন করার ভঙ্গিতে ঝাপটে ধরলো দোকানিকে। সাবাই তো হতভম্ব। আর ওদিকে নকিব সাহেব মাথায় নতুন চিন্তা ঢোকালেন, আচ্ছা ওরা এমন ভাষায় কথা বললো কোনো !
বেথুলদি
বাড়িতে খোলামেলা কথা বলার উপায় নেই। বাবা খুব রাগি। একটুতেই রেগে যান। তাই সারাদিন বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকা ছাড়া কোনো বিকল্প খুঁজে পাই না। তবে হ্যাঁ, বাবা তো আর সব সময় বাড়িতে থাকেন না। সকালে যখন বাজারে যান কিংবা বিকেলে দুধের বোতল হাতে ঘোষ পাড়ার দিকে, তখন মনে হয় প্রাণে প্রাণ ফিরে এলো। মা’র কাছেই যতো আবদার, এবার পরীক্ষা শেষে দু’সপ্তাহ নানার বাড়ি থাকবো, এই বলে দিলাম। আচ্ছা, এই বলে মাথা নেড়ে মা থেমে যান। কিন্তু মামা এসে বললেন এবার আমরা চাঁইপাড়ার বেথুলদি’র বাড়ি যাবো। হ্যাঁ মামা, যে প্রতিদিন সবজি বিক্রি করতে আসে তার কথা কথা বলছো। ঠিক ধরেছিস। এবার পড়ায় মন দে। চোখের পলকে সময় চলে যায়। পড়া এড়ানো সেই আমি এখন জোহা হলে থাকি। ফাইন আর্টসে এবার ফাইনাল দিবো। এক এক করে এতোগুলা পরীক্ষা শেষ হলো অথচ সেই বেথুলদি’র বাড়ি আজও যাওয়া হলো না। তবে এবার মনে মনে পণ করেছি, যাবোই। নব্বই দশকের শেষের দিকে। ফাইনাল হতে আর মাত্র দু’মাস বাকি। রাতে হলের ডাইনিংয়ে প্লেটটা হাতে করে তাতে একটু লবণ ঘষে নিচ্ছি এমন সময়, ওই শুনেছিস কালকে হল খালি করতে হবে। পুলিশ রেইড দিলো, দুই’শ দুইয়ে দুইটা লোহার রড় আর চারে একটা রামাদ-কুড়াল পেলো। বলিস কি ! হ্যাঁ, তাই তৈরি হয়ে নে। তাহলে পরীক্ষা !, জীবন থাকলে তবেই না পরীক্ষা। সেই রাতেই হল ছাড়লাম। পাশের একটা মেসে খুব কষ্টে পড়া-শুনা করে ফাইনালি পরীক্ষা শেষ করলাম। এখন অফুরন্ত সময় এই ভাবতেই বাড়ি থেকে মেসের ঠিকানায় চিঠি এলো, মাস্টার্স্ শেষ করেছো এবার বিসিএস’র প্রস্তুত্তি নাও। চিঠি পেয়ে তো আমি হতভম্ব। বাবা বলে কি ! কিন্তু খুশির খবর হলো মামা আমার মেসে চলে এসেছে। ওই যে বেথুলদি’র বাড়ি যেতে হবে। মামা, আজ রাতটা থেকে তবে কাল ওখানে রওনা দিলেই হবে। আজ রাতে তোমার কাছে তার অনেক গল্প শুনবো। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বেথুলদি’র বয়স পঁচাশির কোঠায়। অথচ এতো বছর জীবনে কথনো নাকি ভাত মুখে তুলেননি। তিন বেলা রুটি খেয়ে দিন কাটান। আর সবজি বেচে যা আয় হয় তা নাকি অসহায়দের মাঝে বিলিয়ে দেন। কিন্তু এর রহস্য কি মামা ? না, ডাক্তারও ভাতের রহস্য ভেদ করতে পারেনি। বেথুলদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাদের আক্রমণে আহতদের সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলো। তাই এমন বীর সৈনিকের সাথে সাক্ষাৎ করা একটা আনন্দের ব্যপার। এখন ঘুমিয়ে পড়। সকালে পেপার ওয়ালা ডাকলো, পেপার হাতে নিতেই মাথাটা কেমন ঘুরে গেলো..মুক্তিযুদ্ধের সাহসী বীর বেথুলদি আর নেই..। পরীক্ষা শেষে ভ্রমণ স্বপ্ন আমাদের অপূর্ণই থেকে গেলো।
নপুংসকের খুলি
পড়া পরীক্ষা গÐির মধ্যে থাকা কার ভালো লাগে বলুন। এর থেকে বেরিয়ে মুক্ত বলাকার মতো ডানা মেলে আকাশ থেকে মাটির পৃথিবীটাকে দেখবো এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কি হতে পারে বলুন। কিন্তু পেটের জ্বালাটা বড় অসভ্য, ধনী-গরিব উঁচু-নিঁচু জাত-পাত কিছুই বোঝে না। আর তার জন্যই আমাকে ঘর মুখো হতে হয় দু’বেলা। নইলে কে যায় ওই ঘরে ! যেখানে গাদা মারা বইয়ের ঢিবি। আর সারাক্ষণ পড় ! পড় ! মুখস্থ বুলি আওড়ানো। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে তবু নয় ক্লাসের বার্ষিকে বসেছি। কিন্তু তার আগেই পরীক্ষা শেষে কোথায় যাবো তার প্ল্যান-প্রেগ্রাম করা শেষ। পদ্মার ওপারে চর আষাঢ়িয়া দহ, ওখানে আমার খালা থাকে এবার ওখানে যাওয়া যাবে। আরিফের সাথে কথা ফাইনাল। যথারীতি পরীক্ষা শেষ হলো। এবার যাবার পালা আমরা বিকেলেই পাড়ি জমালাম ওপারে। নদীর বুকে চর জেগেছে, মাঝে মাঝে নৌকা থেমে যাচ্ছে। ড্রেজার দিয়ে বালি কেটে গতিপথ তৈরি করা হয়েছে, সাপের মত সেই পথ ধরে খালার বাড়ি গেলাম। ওখানে প্রতি সোম-শনিবার হাট বসে। আর সে হাটে গুড়ের জিলেপি বেশ নাম করা। তাই শুনে আরিফ আর আমি গেলাম। কৈশরের কাঁচা বুদ্ধি, জিলেপি কেনা ফেলে রেখে ভিড় ঠেলে জাদু দেখতে ঢুকলাম। দেখি একটা মাথার খুলি হাতে- ‘ সবাই হাতের বাঁধন খুলে দেন, টাকা পয়সা থাকলে এখানে ফেলে দেন, এই বাচ্চা এই দাগের ভিতর আসবি না। দেখনতো বাবাজি ওই সাদা কাপড়ে ঢাকা বাচ্চার মাথা ধড় থেকে আলাদা হয়েছে কি না,ওই থাম ! কষ্ট পাইস ন্যা, টাকা পাবি। লাগ ভেলকি লাগ, চোখে মুখে লাগ!’ এমন সব কথার জাদুতে কথন যে আমারা হাতের টাকা দিয়েছি জানি না। আর ভয়ের ব্যাপার হলো ওই জাদুকর হকার বলছে ‘ যে টাকা না দিবেন, ভাই-বন্ধু বেয়াদবি নিবেন না, নিজ নিজ জাগায় হাত দিয়ে দেখবেন আপনার অস্ত্র নাই।’ পরীক্ষা শেষে এ মজার অভিজ্ঞতা আর একটা বেদনা যুক্ত হলো। মসকরাতে কি না হয় !, তখন আঁধার রাত। হাট থেকে মাল-সামানা মাথায় করে বজু মামা রোজই এই পথ দিয়ে ফিরে। আমরা ওই পথে একটা লম্বা কালো রঙ করে তার মাথায় কালো সুতো বেঁধে তাতে একটা সাদা কাপড় আঁটকে দিই। বজু মামা আসছে সাড়া পেয়েই ওই কালো সুতোই আড়াল থেকে আসতে আসতে টান দিই। অন্ধকারে সাদা কাপড় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এই দেখে বজু মামা অজ্ঞান হয়ে যায়। তারপর জ্ঞান ফিরলেও মামা আর আগের মত স্বাভাবিক হতে পারে নি। এখনও সে অস্বাভাবিক জীবন-যাটন করছে। তার জন্য এখনও নিয়ত ঠোকর মারে নিজের অপরাধ বোধ। যা আজও মামা জানতে পারেনি।